প্রোটিন রহস্যের সমাধান করে রসায়নে নোবেল পেলেন তিন বিজ্ঞানী


রসায়নে এবারের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে প্রোটিন গবেষণার জন্য। কম্পিউটেশনাল প্রোটিন ডিজাইনের জন্য এই পুরস্কারের অর্ধেক পেয়েছেন মার্কিন বিজ্ঞানী ডেভিড বেকার। আর প্রোটিনের গঠন অনুমানের জন্য বাকি অর্ধেকটা পেয়েছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডেমিস হ্যাসাবিস ও মার্কিন বিজ্ঞানী জন এম জাম্পার।

এত কিছু থাকতে প্রোটিন গবেষণায় রসায়নের নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কারণ কী? আসলে, প্রাণের এত যে বৈচিত্র্য চারপাশে, তার পেছনের মূল কৃতিত্ব প্রোটিনের। এগুলোকে বলা যায় জীবনের গাঠনিক একক। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এগুলোকে বলতে চাইবেন ‘জীবনের ভিত্তিমূলক একধরনের রাসায়নিক টুল’। জীবনের মূল ভিত্তি বলতে যেসব রাসায়নিক বিক্রিয়াকে বোঝানো হয়, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার কাজটি করে এই প্রোটিনই। আবার হরমোন, অ্যান্টিবডি এবং বিভিন্ন কলা বা টিস্যুর গাঠনিক একক হিসেবেও কাজ করে প্রোটিন। এবারের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীরা সেই প্রোটিনের গঠনের নেপথ্যের কোড ক্র্যাক করেছেন। আরেকটু সহজ করে বলা যায়, তাঁরা প্রোটিন হ্যাক করেছেন!

একটু খোলাসা করা যাক। যেকোনো প্রোটিন সাধারণত ২০ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিডের নানা ধরনের বিন্যাসের ফলে গঠিত হয়। অর্থাৎ এই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলোকে বলা যায় প্রাণের মূল ভিত্তি বা গাঠনিক একক। অ্যামিনো অ্যাসিড মিলে মিলে প্রোটিন গঠন করে, আর এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে জৈবনিক সব রাসায়নিক বিক্রিয়া।

১৯ শতকের বিজ্ঞানীরা প্রোটিনের এই গুরুত্বের কথা জানতেন। জানতেন, জীবনের গাঠনিক একক প্রোটিন। কিন্তু এগুলোর খুঁটিনাটি বোঝার প্রক্রিয়াটি শুরু হতে হতে ১৯৫০-এর দশক চলে আসে। এর আগে বিজ্ঞানীরা প্রোটিন বিশ্লেষণের কোনো পথ খুঁজে পাননি। সেই সময় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক জন কেন্ড্রু ও ম্যাক্স পারুৎজ প্রথম এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির মাধ্যমে প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করেন। এ জন্য ১৯৬২ সালে তাঁদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

এরপর গবেষকেরা মূলত এই এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ব্যবহার করে প্রায় ২ লাখ প্রোটিনের ছবি তৈরি করেন। সেটাই গড়ে দেয় এবারের নোবেল পুরস্কারের ভিত্তি। কীভাবে? ঘটনাটা ২০০৩ সালের।

এককালে মানুষ ভাবত, প্রকৃতিতে নেই, এ রকম প্রোটিন বানানো সম্ভব নয়। ডেভিড বেকার সেই ধারণা ভেঙে ফেললেন। ১৯৯৮ সালে তিনি ফোরট্রান নামের বর্তমানের তুলনায় প্রাচীন এক কোডিং ল্যাঙ্গুয়েজে একটা প্রোগ্রাম লিখলেন। নাম দিলেন রোজেটা। সেই রোজেটাকে পরে সি++ (C++) ল্যাঙ্গুয়েজে রূপান্তর করে বানানো হয় রোজেটা২ বা রোজেটা++। এই রোজেটাই খেল দেখাল!

গবেষকদল নিয়ে বেকার প্রথমে একটি প্রোটিনের গঠন তৈরি করলেন। এটি বানাতে কী ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড সিকোয়েন্স বা বিন্যাস লাগবে, তা জানতে পরিচিত প্রোটিনের গঠনগুলো খুঁজে দেখল রোজেটা। এসব গঠন সার্ভারে সংরক্ষণ করে রাখা ছিল। যাহোক, খুঁজে খুঁজে রোজেটা এই প্রোটিন থেকে কিছু অ্যামিনো অ্যাসিডের বিন্যাস নিল, ওই প্রোটিন থেকে নিল আরও কিছু। এভাবে বিভিন্ন প্রোটিনের ভগ্নাংশজুড়ে দিয়ে দিয়ে নকশা করে ফেলল বিজ্ঞানী দলের কাঙ্ক্ষিত সেই প্রোটিনের!

এবার পরীক্ষার পালা। প্রয়োজনীয় জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হলো ব্যাকটেরিয়ার দেহে। (এভাবে ব্যাকটেরিয়ার দেহে জিন ঢুকিয়ে দিয়ে ডায়াবেটিসের প্রতিষেধক ইনসুলিন তৈরির কথা অনেকেই হয়তো জানেন।) জিন থেকে ব্যাকটেরিয়ার দেহে তৈরি হলো অ্যামিনো অ্যাসিড, সেখান থেকে প্রোটিন। এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা গেল সেটার গঠন। বিজ্ঞানীরা চমকে উঠে টের পেলেন, ডেভিড বেকারের রোজেটা অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছে। কম্পিউটারের সাহায্যে বেকার তৈরি করে ফেলেছেন সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কৃত্রিম প্রোটিন!

ভিন্ন ধরনের এই প্রোটিনের নকশা করেই তিনি থেমে যাননি। তাঁর দলের বিজ্ঞানীদের নিয়ে একের পর এক বিচিত্র ধরনের প্রোটিনের নকশা করে গেছেন। এসব প্রোটিনের কোনোটি ফার্মাসিউটিক্যালসে ব্যবহৃত হয়েছে, কোনোটি লেগেছে ভ্যাকসিন তৈরির কাজে; কোনো কোনোটি দিয়ে বানানো হয়েছে ন্যানোম্যাটেরিয়াল ও অতি খুদে সেন্সর।

এবারে দ্বিতীয় গবেষণাটির কথা বলা যাক। এটা হলো, প্রোটিনের গঠন অনুমান। আগেই বলেছি, অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো মিলে মিলে প্রোটিন গঠন করে। এগুলো দীর্ঘ এক স্ট্রিং বা সুতোর মতো গঠনে যুক্ত হয়ে ত্রিমাতৃক একধরনের কাঠামো তৈরি করে। এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস বুঝতে হবে—একটা প্রোটিন কী কাজ করবে, তা নির্ভর করে এর গঠনের ওপরেই। সেই ১৯৭০ দশক থেকেই গবেষকেরা অ্যামিনো অ্যাসিডের সিকোয়েন্স বা বিন্যাস দেখে প্রোটিনের গঠন অনুমানের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কাজটা খুব কঠিন। কিন্তু আজ থেকে মাত্র চার বছর আগে সেই কঠিন সমস্যার সমাধান নিয়ে হাজির হলেন ডেমিস হ্যাসাবিস ও জন জাম্পার। কীভাবে সমাধান করলেন? কীভাবে আবার, এআই আছে না!

অসম্ভবকে সম্ভব করা এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজ। এ কথার সত্যতা আবারও প্রমাণ করে ২০২০ সালে আলফাফোল্ড২ নামে একটি এআই মডেল উদ্ভাবন করেন এই দুই বিজ্ঞানী। এই মডেলের সাহায্যে গবেষকেরা ভার্চ্যুয়ালি বা সিমুলেশনের মাধ্যমে অ্যামিনো অ্যাসিড সাজিয়ে সাজিয়ে যে ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি প্রোটিনের গঠন শনাক্ত করেছেন, সেগুলোর প্রতিটির গঠন অনুমান করলেন তাঁরা। রসায়ন বা জৈব রসায়ন শুধু নয়; চিকিৎসাবিজ্ঞান কিংবা মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর দেহের গঠন ও কাজ বোঝার ক্ষেত্রে এ এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। এর পর থেকে ইতিমধ্যেই ১৯০টি দেশের ২০ লাখের বেশি মানুষ আলফাফোল্ড২ মডেল ব্যবহার করেছেন। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের মতো সমস্যা আরও ভালোভাবে বোঝা বা প্লাস্টিককে ভেঙে ফেলতে পারে, এমন এনজাইমের ছবি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এই মডেল।

প্রোটিন ছাড়া জীবন আসলে সম্ভব হতো না। আর এখন আমরা এবারে রসায়নে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ত্রয়ীর কল্যাণে সেই প্রোটিন ইচ্ছেমতো তৈরি করতে পারছি, ভিন্ন ভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিড পর পর বসিয়ে তৈরি নতুন সেই বিন্যাসের গঠন ও কাজ কী হবে, তা অনুমান করতে পারছি—মানব ইতিহাসের অন্যতম অমূল্য কাজগুলোর একটি বলে যে তাঁদের গবেষণা বিবেচিত হবে, এ আর বিচিত্র কী!

শেষে একটুখানি মজার একটা প্রশ্ন করা যাক। এই নোবেলটা কি বিজ্ঞানীরা পেলেন, নাকি এআই পেল—কী মনে হয়? চলতি বছরে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলের পর রসায়নে নোবেল—এই প্রশ্নটা জোর দিয়ে না করে আসলে উপায়ও নেই।

 

 

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন